"অতি দর্পে হতা লঙ্কা" এবং, ইষ্টবেঙ্গল

ছোটবেলায় স্কুলে থাকার সময় সংস্কৃত আমরা সকলেই পড়েছি।

 চাণক্য লিখে গেছিলেন "অতি দর্পে হতা লঙ্কা"!

আশাকরি স্লোকটার সাথে কম বেশি সবারই পরিচয় আছে। এই স্লোকটার মানেটাও সবাই জানেন।

রাবণের কোন কিছুর অভাব ছিল না। কিন্তু অন্য অনেক কিছুর মতোই অহংকার টাও একটু বেশিই ছিল রাবণের; শেষমেষ সেই অহংকারটাই রাবণের পতনের কারণ হয়।

বছর পাঁচেক আগে আমাদের পড়শী ক্লাব ইস্টবেঙ্গল এ আসে কোয়েস নামক এক ইনভেস্টর সংস্থা।
রমরমিয়ে শুরু হয় ইস্টবেঙ্গল এর দল গঠন।
নতুন ইনভেস্টার এসে ক্লাবে পরিকাঠামো গড়ে তুলতে ইনভেস্ট করে। আই লীগে থাকাকালীনই জনি একোষ্টার মতো বিদেশী বা অথবা আলেহন্দ্র মেলেন্দেজ গার্সিয়া এর মত কোচ এনে তারা তাদের মনোভাবটা পরিষ্কার করে। বেশ বড় অঙ্কের চুক্তি বেঙ্গলি ইনভেস্ট করে এবং স্বাভাবিক ভাবেই ইস্টবেঙ্গল ফ্যানেরা খুশি ছিলো, তারা ভেবেছিল তাদের ক্লাব শেষমেশ একটা ভালো হাতে পড়েছে!

ইস্টবেঙ্গল ফ্যানদের খুশির অনেক কারণ ছিল।প্রথম মরসুমে মালয়েশিয়ার মত দেশে ট্রেনিং, বা কোয়ালিটি বিদেশীদের আনা, সাথে কোচকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া; এ জিনিস কলকাতা ময়দান খুবই কম বার দেখেছে!

ঘটনাচক্রে এই সময়েই আমাদের ক্লাব মোহনবাগানে চলছিল ফাইনান্সিয়াল স্ট্রাগল। ২০১৪-১৫ আই লিগ জেতার সত্বেও ম্যাকডাওল স্পন্সরজেক্ট ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এবং কিছু অর্বাচীন কর্মকর্তা, যারা ক্লাব চালানোর থেকে নিজেদেরকে ভগবান বানানো তেই বেশি গুরুত্ব দেন, তাদের সৌজন্যে মোহনবাগান প্রায় তিন চার বছর ছিল স্পনসর-হীন। কিছু কিছু সময় গেছে যখন প্লেয়ারদের মাইনে পর্যন্ত দিতে পারেনি ক্লাব, কিছু সময় গেছে যখন কল্যাণীর মত জায়গায় ম্যাচ অরগানাইজ করে হোটেলের টাকা মেটাতে পারেনি ক্লাব। সেই সময় বিভিন্ন মোহনবাগান ফ্যানেরা একটি ছাতার তলায় এসে একটি সংগঠন তৈরি করে 'হোক প্রতিবাদ'নামে। শুরু হয় এক অসম যুদ্ধ ক্লাব কর্তাদের বিরুদ্ধে, যাতে আমাদের সাধের মোহনবাগান কর্পোরেট হাতে পড়ে।

এই অব্দি সবটাই ঠিক ছিল, কিন্তু গোল বাঁধে ইস্টবেঙ্গলের কিছু সমর্থক এর পাকামোতে। কোয়েস ইনভেস্টার আসার পরে এবং মোহনবাগানের ফাইনান্সিয়াল স্ট্রাগলের খবর বাইরে ছড়িয়ে পড়ার পরে তারা টিফো লেখে 'ভিখারি মাচা' লিখে এবং সেটা নিয়ে মোহনবাগান ক্লাবের সামনে মিছিল করে; সেখানেই শেষ নয়, মোহনবাগান সমর্থক গরীব ঘুগনি বিক্রেতা রাহুল, তাকেও অপমান করতে ছাড়েনি ইস্টবেঙ্গলের সমর্থকরা!
শোনা যায় কোন এক ম্যাচ ডে'তে রাহুলের দিকে অবজ্ঞা ভরে এক টাকার কয়েন ছুঁড়ে দেয় তারা।
 সেখান থেকেই পতন শুরু হয় ইস্টবেঙ্গলের। কোয়েস থাকা সত্ত্বেও,  কোয়েসের সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ইস্টবেঙ্গল আই লিগ জিততে পারে না। মিনার্ভার কাছে তাদের দ্বিতীয় হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়; তীব্র ফাইনান্সিয়াল স্ট্রাগেল-এর মধ্যেও তার পরের মৌসুমে মোহনবাগানে শুরু হয় স্প্যানিশ এরা। মোহনবাগানে আসেন কিবু ভিকুনা এবং তার স্প্যানিশ আর্মাডা। এবং স্বভাবদোষ বশত ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা তাকেও ছোট করতে ছাড়েননি; কিবু'কে মিস্টার বিন বলে টিপ্পণ করেন তাদের সমর্থকেরা; 

কিন্তু ফুটবল খেলাটা হয় মাঠে এবং ফুটবলে নিজেদের সবরকম প্রচেষ্টার পরেও ফুটবল দেবতার'ও একটা ভূমিকা থেকে যায়। নিজের প্রথম সিজনে এসেই আলেহান্দ্রো কে মাৎ দেন কিবু। মরশুমের প্রথম আই লিগ ডার্বিতে কিবু'র কাছে হেরে চাকরি খোয়াতে হয় আলেহান্দ্রো'কে! 

কিবু আই লিগ যেতেন, মোহনবাগানের হাত ধরতে এগিয়ে আসে, আরপিএসজি সংস্থার মতো ইনভেস্টার; মোহনবাগানের ফুটবল টিমের সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয় আরপিএসজি'র টিম এটিকে কে; এবং মুখ্যমন্ত্রীর দয়ায় কোনভাবে শ্রী সিমেন্টকে ইনভেস্টার করে আইএসএলে ঢোকে ইস্টবেঙ্গল। ২০১৯-২০ তে আইলিগ জিতলেও ২০-২১ আইএসএল মরশুমে  আরো ভালো ফল করার লক্ষ্যে ঝাঁপায় মোহনবাগান। কিন্তু এটিকে নামটা থাকায় আমরা অনেকেই সেটা মানতে পারিনি, তাই আমরা প্রোটেস্ট চালু করি রিমুভ এটিকে আন্দোলন নামে।

যাই হোক ইস্টবেঙ্গল সমর্থকেরা মাঠে কিছু করতে পারছিলেন না তাই সোশ্যাল মিডিয়ায় তারা তাদের নতুন ট্রফি "মাচারা মা বেচে দিয়েছে" নিয়ে সেলিব্রেশনে নামেন। দুঃখের ব্যাপার তাদের সেই ট্রফিটা ও বেশিদিন স্থায়ী হয় না; এটিকে মোহনবাগান আই এস এল জেতার পরে চেয়ারম্যান সঞ্জীব গোয়েঙ্কা সমর্থকদের দাবিতে মান্যতা দিয়ে এটিকে সরিয়ে দেন।

অন্যদিকে ইস্টবেঙ্গল সমর্থকেরা যারা এখনো তাদের ঔদ্ধত্য বজায় রেখে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তারা নিজেদের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জায়গায় এখনো মোহনবাগানকে নিয়ে অবসেশড!

যেখানে মোহনবাগান টিম করতে এখন খরচ করে ৫০ কোটি টাকা, সেখানে ইস্টবেঙ্গলের বাজেট এই মুহূর্তে মেরে কেটে ২৫ থেকে ৩০ কোটি!

যে মোহনবাগান সমর্থকদের একদিন এক টাকার কয়েন ছুড়েছিল ইস্টবেঙ্গল বা যাদেরকে ভিখারি মাচা বলে টিপ্পনি কেটেছিল; সেই মোহনবাগান এখন ভারতবর্ষের অন্যতম ধনী দল। অন্যদিকে ইস্টবেঙ্গল এখন রাজ্যে রাজ্যে ঘুরে ক্রাউড ফান্ডিং এর পথে হাঁটছে। ক্রাউড ফান্ডিং এর পথে হাঁটলেও তাদের নিজেদের সমর্থকটাই প্রশ্ন তুলছেন যে তারা ক্রাউডফান্ডিং করবেন কেন!

শুরুটা করেছিলাম "অতি দর্পে হতা লঙ্কা" লিখে; রামায়ণের সময় থেকে যে জিনিসটা সবার মুখে মুখে ফেরে, সেটা যে এখনো সত্যি, তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ বোধ হয় ইস্টবেঙ্গল! 

তাই সবাইকে অনুরোধ, জীবনে যাই অ্যাচিভ করে নিন, কোনোদিন সেটা নিয়ে অহংকার করবেন না!

আর মোহনবাগান সমর্থকদের অহংকার করা মানায়'ও না।

জয় মোহনবাগান

Comments

Popular posts from this blog

The Man, The Myth, The Legend: SANDIP MOIRA

Test: ISL Table mbft

Exclusive: Mohun Bagan have identified Aiden O'Neill to reinforce the Midfield, but player is 'Not Convinced' yet.