Archive থেকে: কিবু ভিকুনা, এক রাজার রাজ্য জয়ের গল্প

৩রা মে, ২০২০:

সময়টা আগের বছরের মে মাস। আগের সিজনে জঘন্য পারফরমেন্স, যা মোটেও মোহনবাগান সুলভ নয়! তাই কর্তাদের চ্যালেঞ্জ ছিলো এবারে একটা স্বপ্নের সিজন উপহার দেওয়ার। ২০১৪-১৫র আই লীগ জেতা মরসুম থেকে ২০১৭-১৮য় শঙ্করলালের হাত ধরে লীগে অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তনে প্রায় লীগ জিতে ফেলা! ২০১৮-১৯ সিজনটায় অনেক স্বপ্ন নিয়ে শুরু করেও রীতিমত মুখ থুবড়ে পড়া, আর পড়শী ক্লাবে স্প্যানিশ জামানার শুরু.. এতো কিছুর পরে ২০১৯-২০তে কর্তাদের ভালো কিছু উপহার দিতেই হতো। গতবছরে এপ্রিল-মে থেকেই গুঞ্জন চলছিলো, বাগানে এবার আবার বিদেশী কোচ আসবে। কেউ করিম চাচা বা কেউ অ্যাশলে ওয়েস্টউড বা কেউ আবার কাশ্মীরের রবার্টসনের নাম ভাসাচ্ছিলেন। এমন সময়ই ১১মে অফিশিয়াল সাইটে ঘোষনা হলো, মোহনবাগানের নতুন কোচ পোলিশ লিগের পরিচিত মুখ জোসে অ্যান্তোনিও ভিকুনা ওচান্দ্রেনা ওরফে কিবু ভিকুনা। অর্থাৎ বাগানে স্প্যানিশ যুগের সূচনা।

কিবু ভিকুনা নামটা তখন এক্কেবারে অপিরিচিত, একমাত্র ইন্টারনেট-ই সম্বল কিছু জানার জন্য। সেই ইন্টারনেটেই বায়ো দেখলাম, ভদ্রলোক লা লীগার ক্লাব ওসাসুনার ইউথ টীমে বেশ কিছুদিন ছিলেন, তারপর থেকে অধিকাংশ ক্লাবেই অ্যাসিস্টেন্ট কোচ হিসেবেই কাটিয়েছেন। সেখানেও বড়ো ক্লাব বলতে পোলিশ লীগের লেগিয়া ওয়ারশ এবং লা লীগায় ওসাসুনাতে সহকারী হিসেবে সময় কাটানো। ২০১৮তেই ম্যানেজার হিসেবে কাজ শুরু, এবং লিথুয়ানিয়ার এফকে রিতেরিয়াইতে তার কেরিয়ারের শুরু। সেখানে কয়েকমাস কাটিয়ে পোলিশ লীগের উইস্লা পোলকে যোগদান। দুটো ক্লাবেই কিবুর অধীনে তেমন সাফল্য আসেনি, তবে পোলিশ লীগ আর আই লীগ সমমানের নয় মোটেই! তাই আশাও জেগেছিলো, হয়তো এবার ভালো কিছু হবে। কিবু এলেন, এসেই সমর্থক দের আশ্বাস দিলেন "Dream Big, Support Fearlessly"... কিন্তু শুধু মুখের আশ্বাসেই কাজ হয়না। তার ছাপ কাজের মধ্যে দেখতে পেলেই মানুষ ভয় কাটিয়ে যুদ্ধ জয়ের সাহস দেখাতে পারে! এহেন কিবু ভিকুনার মোহনবাগানে যাত্রা শুরু হলো ডুরান্ডে পাসের ফুলঝুড়ি ছুটিয়ে মহামেডান কে বধ করে! সেদিন শুধু teaser প্রকাশ পেয়েছিলো এ মরসুমের। কিবু ভিকুনা তখন মোহন জনতার মনে একটু একটু করে আশা জাগাচ্ছেন বটে, কিন্তু কলকাতা লীগে ইনকনসিসটেন্ট পারফর্মেন্স তাকে দরাজ সার্টিফিকেট পেতে দিচ্ছেনা। এই কিবুর আমি তখন সমর্থক, কিন্তু ভক্ত হয়ে যাইনি। 
এরপরে সেই সিএফএল ডার্বি, একদিকে আগের বার আই লীগে একেবারে অল্পের জন্য লীগ না পাওয়া, ৪০০কোটির গরিমায় অন্ধ হয়ে যাওয়া, স্পর্ধার শতবর্ষ নিয়ে সেলিব্রেট করা ইস্টবেঙ্গল এবং তাদের ম্যাজিশিয়ান আলে স্যার। অন্যদিকে সেই ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের বিদ্রুপের শিকার, ভিখারী মাচা মোহনবাগান‌ এবং সেই মোহনবাগানে এক্কেবারে নতুন মুখ কিবু ভিকুনা, যাকে কটাক্ষ করে ইস্টবেঙ্গল সমর্থকেরা মিস্টার বিন বলে ডাকছে। সেই ডার্বিতে ইস্টবেঙ্গল-ই ফেভারিট এবং ধারেভারে এগিয়ে.. সেখানে তরুন তুর্কি সাহিল, এবং ফ্র্যান গঞ্জালেজকে দিয়ে ইস্টবেঙ্গল মাঝমাঠে পুরো অকেজো করে দেওয়া, বাতিল গুরজিন্দরকে সাইড ব্যাক থেকে সেন্ট্রাল ব্যাক করে দেওয়া এবং আলে স্যারের সব ট্যাকটিক্স কে ধুলিসাৎ করে দেওয়া। হ্যাঁ, ম্যাচটা ম্যাড়ম্যাড়ে ড্র হয়েছিলো, কিন্তু ট্যাকটিকাল ব্যাটেলে মিস্টার বিন ওপাড়ার ম্যাজিশিয়ানকে ৫গোল মেরেছিলেন... সেদিন থেকে আর সাপোর্টার না, কিবুদার ফ্যান বয় হয়ে যাওয়া... 
এরপর ডুরান্ডের ফাইনালে যুবভারতী ভরিয়ে দিয়েছিলো মাচারা, এমন অনেক লোক সেদিন মাঠে গেছিলেন যারা শেষ ৭-৮ বছরে মাঠে যেতেন না.. এটাই কিবু ভিকুনার সাফল্য। দিনের শেষে সেদিন মোহনবাগান ফাইনাল হেরেছিলো, কিন্তু কিবুর মন্ত্রে মোহন জনতা তখন বিশ্বাস করতে শিখে গেছে। তখন মোহন জনতা বিগ ড্রিম দেখছে, প্রস্তুতি নিচ্ছে ফিয়ারলেসলি সাপোর্ট করার... এরপরে শেখ কামাল কাপ, এবং সেখানেও ব্যার্থতা। তখন একটু একটু করে স্বপ্ন ভঙ্গের প্রস্তুতি নিচ্ছি, এবার বোধহয় হোলো না। আই লীগের শুরুতেও ধাক্কা, প্রথম ম্যাচে দুর্বল আইজলের বিরুদ্ধে মাত্র ১ পয়েন্ট এবং তার পরের ম্যাচে ঘরের মাঠে ৪-২এ দুরমুশ হওয়ার ধাক্কা। লীগ জেতার আশা ছেড়ে দিয়েছি, ইস্টবেঙ্গল লীগ না পেলেই হবে, সেই প্রস্তুতি নিচ্ছি.. এবং এরপরেই কিবু্র বাজিমাত।

এরম খাদের কিনারায় থাকার সময় আপনার কাছে দুটো রাস্তা থাকে, প্রথমটা খুব সহজ.. সব দায়ভার ঝেড়ে পালিয়ে যাওয়া। আর দ্বিতীয়টা! সেটা বেশ কঠিন.. নিজের সব ভুলভ্রান্তি গুলো শুধরে পাল্টা মার দেওয়া, ফিরে আসা।
কিবু ভিকুনারা দ্বিতীয় গোত্রেরই হন বরাবর; তাই পালিয়ে যাওয়ার সহজ পন্থা নয়, বরং যারা তার কথায় বুঁদ হয়ে big dream এ আচ্ছন্ন হয়ে আছে, তাদের সত্যি সত্যিই ফিয়ারলেসলি সাপোর্ট করার মঞ্চ দেওয়ার পন্থা টাই তারা বেছে নেন। তাই কিবু ভিকুনা অনায়াসে নিজের ইগোকে প্রফেশনের মধ্যে আসতে না দিয়ে তার পছন্দের সালভা চামোরোকে বাদ দিয়ে দিতে পারেন, তিনি পাপা বাবাকার দিওয়ারাকে চোট থেকে ফিরলেও আস্থা এবং ভরসা যুগিয়ে মিস্টার ডিপেন্ডেবল বানিয়ে দিতে পারেন। কিবুর দর্শনের যে ফুটবল, সেটা তার গোটা টিম চার্চিল ম্যাচেই খেলে দেখিয়ে দিয়েছিলো.. সে যতই ৪-২এ হারুক না কেনো.. সেই টীমে শুধু একজন পজিটিভ বক্স স্ট্রাইকার দরকার ছিলো। পাপা এলেন কিবুর সাজানো zigsaw puzzle এর সেই একমাত্র মিসিং টুকরো টা নিয়ে, আর পাজেলে সেই টুকরো টা জুড়তেই কিবুর অশ্বমেধের ঘোড়া থামায় কার সাধ্যি। তাই প্রথম দুই ম্যাচে পয়েন্ট নষ্টের খেসারত আর দিতে হয়নি মোহনবাগান কে। সমর্থকদের ভালোবাসা টা কিবু ফিরিয়ে দিয়েছেন আই লীগ ট্রফি হিসেবে‌। ঠিক যেভাবে বাড়ির বড়ো দাদা তার বাচ্ছা ভাই-বোন গুলোর ভালোবাসা ফিরিয়ে দেয় পুজোয় নতুন জামা কিনে দিয়ে। ঠিক সেইজন্যেই গঙ্গাপাড়ের ক্লাবে কিবু ভিকুনাকে স্যার হতে হয়নি, বরং তিনি মোহন জনতার আদরের কিবুদা হয়ে গেছেন।
মোহন সমর্থকরা এই কিবুদাকে কখনো হয়তো ভুলতে পারবেন না, তবে ভুলতে কি পারবেন তার ছাত্ররা? পুরো কেরিয়ারে চোটগ্রস্ত তকমা দেখে থাকা ভিপি সুহের পারবেন ভুলতে যে তিনি কিবুর অধীনে এবছর সেভাবে চোটের জন্য ম্যাচ মিস করেন নি! নংডাম্বা নাওরেম কি ভুলতে পারবে, তার অতিরিক্ত বল হোল্ড করে খেলার রোগ থেকে তাকে মুক্তি দিয়েছেন এই কিবু ভিকুনা। আশুতোষ মেহতা বা ধনচন্দ্র সিং কি কখনোও ভুলতে পারবেন কিবুর হাতে পড়ে তাদের পুনর্জন্মের কথা? শেখ সাহিল কখনোও ভুলবে, তাকে ভারতের অন্যতম হট প্রস্পেক্ট হিসেবে তুলে আনা কিবু স্যার কে? বা, শুভ ঘোষ? বা কিয়ান নাসিরি? 
নাহ সম্ভব না ভুলে যাওয়া। কিবু ভিকুনারা আসলে সেই রূপকথার গল্পের স্বপ্নের সওদাগরদের মতো। তারা আসেন, তারা জিততে শেখান আর আপনাকে জিতিয়ে দিয়ে আবার চলে যান। 
প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাবের কয়েকজন কিবু কে মিস্টার বিন বলে একসময় খিল্লি উড়িয়েছিলো। সেই মিস্টার বিন বা রোয়ান এটকিনসন, যার শো দেখে সারাদিনের খাটুনির পরেও মন ভালো হয়ে যেতো, সারাদিন যত ঝড়ঝাপ্টাই যাক, মিস্টার বিনের কাজকর্ম দেখে দিনের শেষে ঠোঁটের ডগায় হাঁসি লেগে থাকতো ।
আমাদের কিবুদাও ঠিক তেমন-ই; সারাদিনের খাটাখাটুনির পর মোহনবাগানের খেলা চালিয়ে জাস্ট বসে যান, সব চিন্তা থেকে মুক্তি.. সৃষ্টিশীল ফুটবল, চোখের আরাম দেওয়া ফুটবল সাথে ম্যাচ শেষে তিন পয়েন্ট... আপনার মন ভালো করে দিতে বাধ্য।

কিবু ভিকুনা কেনো এতটা প্রিয়? যে ভদ্রলোক প্রফেশনাল হলেও এক লহমায় বলে দিতে পারেন, আই উইল রিমেন এ মেরিনার ফর দি রেস্ট অফ মাই লাইফ, তাকে ভালোবাসা ছাড়া অন্য কোনো উপায় আছে? যে ভদ্রলোক ভারতীয় না হলেও, শেখ সাহিলের করোনা মহামারীতে গরীব দের সাহায্য করতে দেখে তাকে উদ্বুদ্ধ করেন, নিজেও সেই সাহায্যে অংশ নিতে চান, তাকে শ্রদ্ধা করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় কি আছে?
তাই কিবু্র জন্য লকডাইনের শহরেও টিফো নামে রাস্তায়, কিবুর জন্য magician নয়, বরং Godfather লেখা ব্যানার আসে কল্যানিতে... কিবুর জন্য তার সমর্থকেরা ঔদ্ধত্য শেখে না, বরং কীভাবে মাটিতে পা রাখলেই সাফল্য আসে, সেই শিক্ষা পায়।

প্রিয় মানুষ গুলো এমনই হয়, তারা আসে কিছুক্ষনের জন্য আর ভবিষ্যতের দৃষ্টিভঙ্গিটাকেই বদলে দিয়ে চলে যায়। 
অনেক ধন্যবাদ কিবু ভিকুনা, ঠিক এক বছর আগে মোহনবাগানে এসেছিলে, আজ কলকাতা ছেড়ে চলে যাচ্ছো.. তবে পৃথিবী তো গোল! তাই চলার পথ আবার একদিন মিশবে আশা করি। সেইদিনের অপেক্ষায় রইলাম Gaffer 🙂

Comments

Popular posts from this blog

The Man, The Myth, The Legend: SANDIP MOIRA

Test: ISL Table mbft

Exclusive: Mohun Bagan have identified Aiden O'Neill to reinforce the Midfield, but player is 'Not Convinced' yet.