আর্কাইভ থেকে: কোভিড ও মোহনবাগান
২৯শে জুলাই, ২০২০
শেষ প্রায় ৫মাস ধরে আমরা ঘরবন্দী। দৈনন্দিন কাজের পর ফ্রাস্ট্রেশান আসাটা স্বাভাবিক। ফ্রাস্ট্রেশান থেকে অনেক ক্ষেত্রে ডিপ্রেশান'ও আসে। আর ডিপ্রেসান যে কতটা ভয়াবহ আকার নিতে পারে তা সাম্প্রতিক অতীতে বারংবার দেখা গেছে। তবে আমাদের একটা ফুটবল খেলা আছে, যেটা নিমেষে সব ডিপ্রেশান কে উধাও করে দেয়। সারাদিনের busy schedule এর পরে একটা টানটান ৯০' এর ফুটবল ম্যাচ, প্রিয় দলের জয়, মনটা কে এক মুহুর্তে ফুরফুরে করে দেয়। মাঝেমাঝেই ভাবি, ফুটবল টা না থাকলে হতোটা কি!
তা, এই ফুটবল খেলাটাই যে exist করে, সেটা জানতামই না মোহনবাগান না থাকলে। আমার পরিবার সূত্রে আমিও মোহনবাগানী, ব্যাপারটা মোটেও এরম নয়। ছোটো থেকেই প্রিয় খেলা ক্রিকেট, আর দৈনন্দিন রুটিন ছিলো খবরের কাগজের খেলার পাতাটা আগে পড়া।ছোটোবেলায় ক্রিকেটের খবর পড়তে পড়তে ব্যারেটো, সংগ্রাম, বাইচুং দের নাম শুনে কবে যে মোহনবাগানের ফ্যান হয়ে গেছিলাম , এখন আর মনে পড়েনা। তারপর থেকে আসতে আসতে ক্রিকেট আর মোহনবাগান ছাড়া কিছুই মাথায় ঢুকতো না সেভাবে। কখনো কাগজে পড়ে , কখনো বা কলকাতা টিভি বা জি টিভি তে খেলা দেখে মোহনবাগানের সাথে আসতে আসতে আত্মিক যোগাযোগ শুরু। সেই শুরু ভালোবাসার, যা এখনও চলছে, আজীবন চলবেও। নর্ম্যাল মানুষদের থেকে মোহনবাগানীদের কিছুটা পার্থক্য আছে। আপনি অফিস শেষে বন্ধুদের সাথে লেকের ধারে ঘুরতে যান তো? মোহনবাগানীরা অফিস শেষে একবার মোহনবাগান গ্যালারিতে ঢুঁ মেরে আসে। অচেনা মানুষের সাথে মিশতে আপনার একটু odd লাগে, তাই না? মোহনবাগান গ্যালারীতে বসে একদিন ম্যাচ দেখুন। ধরুন মোহনবাগান গোল দিয়েছে। পাশের যে ছেলেটাকে আপনি বাপের জন্মে কখনও দেখেননি, দেখবেন সে আপনাকে আপনার ন্যাংটো বয়সের বন্ধুর মতো জড়িয়ে ধরে নাচছে.. হ্যাঁ দাদা, এটাই মোহনবাগান। আচ্ছা আপনার যখন মোটিভেশনের অভাব হয়, কি করেন? সন্দীপ মহেশ্বরি দের ভিডিও দেখেন? বা মোটিভেশনাল সিনেমা? মোহনবাগানিরা বলবে ৫বছর কোনো মেজর ট্রফি না জিতে আই লীগ জিতে শাপমুক্তির রাতের কথা, মোহনবাগানীরা বলবে একটা ওডাফা ওকোলির লড়াইয়ের কথা, যেটা মোহনবাগানকে নিশ্চিত রেলিগেশনের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলো। আচ্ছা, ডেডিকেশন বললে আপনার কি মনে আসে? আমার মনে পড়ে জোসে ব্যারেটোর কথা, সুপার কাপের ফাইনালে, খুব সম্ভবত জিভ কেটে গেছে কোনো একটা ডিফেন্ডারের সাথে সংঘর্ষে। সেই অবস্থায় গোল করে মোহনবাগান কে সুপার কাপ জেতানো। এর থেকে ভালো ডেডাকেশানের উদাহরন দিন দেখি।
আচ্ছা, নিঃস্বার্থ ভালোবাসার উদাহারন চাইলে কার কথা মনে পড়ে আপনার? আমার মনে পড়ে একজন জাপানির কথা। কাতসুমি ইউসা। দলের প্রয়োজনে যেখানে যখন কোচ নামাতেন , হাসিমুখে সেই কাজ পালন করে তবেই মাঠ ছাড়তেন বাগানের ফুকুশিমা বোম্বার। এই তো মাহছয়েক আগের কথা, চেন্নাইয়ের হয়ে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে গোল করলেন। কিন্তু কোনো সেলিব্রেশন করলেন না। ম্যাচ শেষে বলে গেলেন মোহনবাগান এখনও তার ঘর।
আচ্ছা বদলা বলতে কি বোঝেন? মোহনবাগানীদের জিজ্ঞেস করুন, দেখবেন সবাই এডে চিডি এবং মোহনবাগানের ইস্টবেঙ্গল'কে ৫গোল মারার গল্প'টা আপনাকে গর্ব করে শোনাবে। আচ্ছা ম্যাজিশিয়ান বললে, আপনার কার কথা মনে পড়ে ? পিসি সরকার? মোহনবাগানীদের জিজ্ঞেস করুন, একটা সোনি নর্দের নাম শুনতে পাবেন, একটা জোসেবা বেইতিয়ার গল্প শুনতে পাবেন। আচ্ছা, গার্লফ্রেন্ডের সাথে ব্রেক আপের পর মন খারাপ হয়? কাঁদেন? মোহনবাগানীরাও কাঁদে। কখনো একটা জোসে ব্যারেটোর শেষবার মোহনবাগান জার্সি গায়ে নামার দিনে, কখনো একটা সরস্বতী পুজোর আগের বিকেলে একটা সোনি নর্দের হঠাৎ পাওয়া চোটে মাঝ মরসুমে দেশে ফেরার দিনে। আচ্ছা লয়্যালটি বললে কার কথা মনে পড়ে আপনাদের। ফুটবল জগতে দেখলে অনেকেই টোট্টির নাম নেবেন বা বুঁফো বা মেসি বা পুয়োলের নাম নেবেন। মোহনবাগানীদের জিজ্ঞেস করুন। দেখবেন একটা সুব্রত ভট্টাচার্য্য বা হালে একটা শিল্টন পালের নাম পাবেন। আচ্ছা dominance বলতে কি বোঝেন? আপনার উত্তর জানিনা, কিন্তু মোহনবাগানীদের জিজ্ঞেস করুন, ২০১৯-২০ মরসুমের কিবু ভিকুনা & কোং এর গল্প শুনতে পাবেন। আসলেই মোহনবাগান একটা সভ্যতা, যার শুরু আছে, কিন্তু শেষ নেই। বিশ্বে কয়েকশো লাখ প্রোফেশনাল এবং অ্যামেচার ফুটবল ক্লাব আছে। কোনো ক্লাবের নাম শুনেছেন, যারা দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সেই দেশের একটা লড়াইয়ের জন্ম দিয়েছিলো? একটা গোটা প্রজন্ম কে, একটা জাতিকে শিখিয়েছিলো ব্রিটিশদের হারানো যায়? হ্যাঁ, ঠিক এখানেই আমার মোহনবাগান আপনাদের অন্য সব ক্লাবের থেকে আলাদা ☺️।
১৮৮৯এর ১৫ই আগস্ট যে ক্লাবের প্রতিষ্ঠা, সেই ক্লাব ১৯১১র ২৯শে জুলাই পুর্নতা পেয়েছিলো। একটা আইএফএ শিল্ড জয়, যেটা শুধুই আইএফএ শিল্ড জয় নয়, বরং একটা জাতির নতুন করে স্বপ্ন দেখার সাহসের জন্মও বটে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে একটা চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন বা একটা রাখিবন্ধন উৎসবের যা মাহাত্ম্য, ২৯শে জুলাইয়ের'ও মাহাত্ম্য সমান। এই মোহনবাগান কে শুধু সমর্থন করা যায়না , ভালোবাসা যায়।
মোহনবাগান আছে বলে সারাদিনের ক্লান্তির পরে ইউটিউবে গিয়ে একটা পুরোনো ম্যাচের হাইলাইট দেখা আছে। মোহনবাগান আছে বলেই মন খারাপের বিকেলে একটা শিলিগুড়ি ডার্বি এবং সোনি নর্দের স্টেনগান সেলিব্রেশান দেখে হঠাৎ-ই মন ভালো হয়ে যাওয়া আছে। মোহনবাগান আছে বলে মাঝেমাঝেই ইউটিউবে আমাদের সূর্য মেরুন গানটা শোনা আছে। মোহনবাগান আছে বলে ৫বার ভারতসেরা হওয়ার গর্ব আছে। মোহনবাগান আছে বলে রোজ এখানে সেখানে নতুন এক দুজন মোহনবাগানীর সাথে পরিচয় লেগেই আছে। মোহনবাগান আছে বলে ভারতীয় ফুটবলে ২৩ পাসের গোল আছে। মোহনবাগান আছে বলে অনেক অচেনা মানুষকেও মোহনবাগান সূত্রে নিজের করে পাওয়ার সৌভাগ্য'ও আছে, যাদের সঙ্গে পরিচয় বেশীদিনের না হলেও সেই "মোহনবাগান" কমন লিঙ্কের জন্যই অনেক নিবিড় সম্পর্ক আছে। আপনি হিন্দু কি মুসলিম জানিনা। আপনি বাঙাল না ঘটি জানিনা। আপনি মোহনবাগানি হলেই হলো ❤️
এই pandemicএও দিনের শেষে একটা মোহনবাগান আছে, কয়েকজন মোহনবাগানী দাদা দিদি আছে, যাদের সাথে ৫মিনিট কথা বলেও দিনটা ভালো হয়ে যায়।
জীবনে খুব কম জিনিস'ই constant রয়ে যায়। বাবা মা, স্কুল কলেজের ২-৩ জন বন্ধু আর একটা মোহনবাগান.. এগুলো irreplaceable ই থেকে যায়।
করোনা কাটলে আই লীগ জয়ের সেলিব্রেশনের অপেক্ষায় এখন-ও আছি, সবাইকে ঐতিহাসিক মোহনবাগান দিবসের অনেক শুভেচ্ছা 💚❤️
Comments
Post a Comment